রাজার ভিটা নামক প্রত্নঢিবি চুয়াডাঙ্গা জেলার সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের অন্তর্গত কালুপোল গ্রামে ২৩০৩৩’৩০.২৯’’ উত্তর অক্ষাংশে ও ৮৮০৫৪’৫৫.০৫’’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে রাজার ভিটা নামে সুপরিচিত প্রত্নস্থানটি গড়াইটুপি থেকে সরোজগঞ্জ গামী পাকা রাস্তার কালুপোল মোড় থেকে ১.৫ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে চিত্রা নদীর মরা খাতের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত।
পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে ঢিবিটি শীর্ষদেশের উচ্চতা প্রায় ৫-৬ ফুট। ঢিবির পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণে ২২৫ ফুট ও পূর্ব-পশ্চিমে ৩৭৫ ফুট। ঢিবির উপরিভাগে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ইটের কণা, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ঢিবির পাদদেশে বিক্ষিপ্তভাবে ইট ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশসহ সাংস্কৃতিক জঞ্জালের (ঈঁষঃঁৎধষ উবনৎরবং) উপস্থিতি রয়েছে। ঢিবির নিচে প্রাচীন স্থাপনার অস্তিত্ত্ব রয়েছে। বর্তমানে ঢিবির শীর্ষদেশ প্রায় সমতল আকার ধারণ করেছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে চুয়াডাঙ্গা জেলায় পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধান কার্যক্রমে রাজার ভিটা নামক প্রত্নঢিবিটি সনাক্ত করা হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে ঢিবির নিচে পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষসমূহ সুলতানী আমলের বিলুপ্ত স্থাপনা বলে প্রতীয়মান হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ কালে ঢিবির শীর্ষদেশে খানজাহান (র:) স্থাপত্য নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ইটের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কয়েকটি বর্গাকৃতি লাল পোড়া টালি ইটের সন্ধান পাওয়া। নির্মাণ উপকরণ ও ইটের পরিমাপ বিশ্লেষণ হতে অনুমান করা যায় যে, ঢিবির নিচে বিলুপ্ত পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষসমূহ খানজাহান (র:) এর সমসাময়িক অর্থাৎ সুলতানী আমলের হতে পারে।
চিত্রা নদীর তীরে অবস্থিত এ প্রত্নস্থানটির প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রত্নাতাত্ত্বিক খনন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় ও এর অধীনস্ত জাদুঘরসমূহের বিভিন্ন গ্রেডের ১২ জন কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত একটি খনন দল গত এপ্রিল, ২০১৭ কালুপোল রাজার ভিটায় পরীক্ষামূলক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যিক অবকাঠামোর ধ্বংসাবশেষসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করা হয়। খনন কার্যক্রম পরিচালনা করে দু’টি নির্মাণ পর্বের সাক্ষ্যবাহী স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ আবিস্কৃত হয় (ইমারতের দেয়াল, সংযোগ দেয়াল, কর্ণার প্রভৃতি)। প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু ও উন্মোচিত স্থাপত্য নিদর্শনের সাথে শহর খলিফাতাবাদ (বাগেরহাট) ও শহর মুহাম্মাদাবাদ (বারবাজার) এর প্রত্নবস্তুর সাথে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
এছাড়াও প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর মধ্যে রয়েছে ফুল লতাপাতার নকশাঙ্কিত পোড়ামাটির ইট, লৌহ নির্মিত বস্তু, স্বল্প মূল্যবান পাথরের পুঁতি, পোড়ামাটির চুড়ির ভাঙ্গা অংশ, পোড়ামাটির বল, পোড়ামাটির গুটিকা, পোড়ামাটির খেলনা, হরিণের শিং এবং বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র (লালচে রঙের বদনার নল, লালচে রঙের তৈল প্রদীপ, নীল গ্লেইজড ওয়্যার, সাধারণ মানের ঘট, পানি খাওয়ার পাত্র, থালা, বাটি, কলস, হাড়ি কড়াই, ঢাকনা প্রভৃতি) প্রভৃতি। এছাড়াও বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে যেগুলো প্রাক-মুসলিম পর্বের নিদর্শন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিস্তারিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে এবিষয়ে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে যা এ অঞ্চলের ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
চুয়াডাঙ্গার আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থে ঢিবির ইতিহাস সম্পর্কে কোন তথ্য লিপিবদ্ধ নেই। তবে স্থানীয় ভাবে প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায় যে, স্থানটি গন্ধর্ব রায় নামক জনৈক রাজার বাড়ি ছিল। যদিও রাজা গন্ধর্ব রায় সম্পর্কে ইতিহাস সমর্থিত নির্ভরযোগ্য কোন সূত্রে পরিচয় জানা যায়নি। প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায় যে, চার আউলিয়ার অন্যতম হযরত ‘মালেক উল গাউচ’ এর সাথে রাজা গন্ধর্ব রায়ের সাথে যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল এবং এই যুদ্ধে রাজা গন্ধর্ব রায় পরাজিত ও নিহত হওয়ায় কথা জানা যায়। জনশ্রুতি অনুযায়ী ‘মালেক উল গাউচ’ প্রখ্যাত সাধক হযরত খানজাহান (র:) ঘনিষ্ঠ সহচর ও অনুসারী ছিলেন। এসকল তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা হয় রাজা গন্ধর্ব রায় সম্ভবত পঞ্চদশ শতকে খানজাহান (র:) সমসাময়িক কোন আঞ্চলিক শাসক বা রাজা ছিলেন।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস