Wellcome to National Portal

Welcome to the website of the Office of the Regional Director, Directorate of Archaeology, Khulna and Barisal Division

মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped


খানজাহান (র) এর বসতভিটা

বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলায় ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় ৩০০মি. উত্তর দিকে অবস্থিত। প্রাচীণ ভৈরব নদীর পূর্ব মূখী বাঁকের দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে ২২.৬৭৮৩৮৯ উত্তর অক্ষাংশ হতে ৮৯.৭৪৩১৪১ দ্রাঘিমাংশে ৯.১১৫ একর জায়গা জুড়ে বাগেরহাট শহর হতে প্রায় ৮ কিলোমিটার উত্তরে বাজেয়াপ্তি সুন্দরঘোনা মৌজা (জে.এল.নং ১৩০), সুন্দরঘোনা মৌজা (জে.এল.নং ১২৯) এবং বাগমারা মৌজায় (জে.এল.নং ১২৯) এই প্রত্নস্থলের অবস্থান।

 

স্থাপনাসমূহের নির্মাণ শৈলি ও নির্মাণ কুশলতার নানা প্রমান পাওয়া যায়। নির্মাণ উপকরণ হিসেবে আয়তাকার পোড়ামাটির ইট,গাঁথুনির উপকরণ হিসেবে কাদামাটি, চুন-বালি, চুন-সুরকি এমনকি শামুক-ঝিনুকের গুড়োর ব্যবহার লক্ষণীয়। দেয়ালকে নোনা ও আর্দ্রতা সহনীয় করতে তারা দেয়ালের গায়ে লাইম ট্রেসিং বা চুনের আস্তরণের ব্যবহার নবতর উদ্ভাবনে সক্ষমতা অর্জন করে। মেঝে নির্মাণে চুন-সুরকি ও শামুক-ঝিনুকের ব্যবহার করা হয়েছে। নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য ব্যতিক্রমী চুন- বালি মিশ্রিত করার একটি আধার পাওয়া  গিয়েছে। নির্মাণ কাজে স্থানীয় উপকরণের ব্যহার লক্ষনীয়। খননে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে রয়েছে একটি সেপটি ট্যাংকসহ পাকা শৌচাগার। পানি সরবারহ কাজে ব্যবহৃত প্রায় ১৭ মিটার দীর্ঘ পোড়ামাটির তৈরি পাইপ। তাছাড়া ইমারতসমূহের বিভিন্ন অংশে পানি নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত  নালা। ইটের তৈরি কাভার্ড নালার উপস্থিতিও লক্ষণীয়।

 

খানজাহান (র) এর বসতভিটা ঢিবিটির অবস্থান পরিবৈশিক কারণে অন্যান্য মধ্যযুীয় মুসলিম প্রত্নস্থলগুলোর থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী। উত্তরবঙ্গে অবস্থিত মধ্যযুগীয় রাজধানী গৌড় এর অবস্থান স্বভাবত:ই প্লাইস্টোসিন যুগের সোপান বা উঁচু ভূমির উপরে অবস্থিত। কিন্তু খানজাহান (র) এর বসতভিটা সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। সমুদ্র সমতল হতে ৫.৩০ মি হতে ২.৫০ মি. উচ্চতার মধ্যেই প্রত্নস্থানটিতে বিভিন্ন ধরনের আলামত পাওয়া যায়। সবচেয়ে নিচের দিকে বসতির আলামত হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র এবং কয়েকটি চুলার সন্ধান পাওয়া যায়। এই লেভেলে কোনো স্থাপনা বা নির্মাণ কাঠামোর আলামত পাওয়া যায় না। এর নিচে এস্তোরিয়ান ডিপোজিট/ ন্যাচারাল ডিপোজিট হিসেবে সুক্ষ হতে মাঝারি আকৃতির বালির নমুনা পাওয়া যায়।

টারেটসহ বর্গাকার স্থাপনার সীমানা প্রাচীরের উপরে একটি মেঝে পাওয়া গিয়েছে। দেয়ালের ভিত পাওয়া গিয়েছে যা গর্ত করে ইট সংগ্রহের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ। সবগুলো বসতি স্তরের মধ্যে কতগুলো বৈশিষ্ট্য খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ। চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি পুরু মেঝে এবং ইটের পাটাতনের ব্যবহার। প্রত্নস্থানটির উত্তর দিকে ভৈরব নদীর প্রাচীন খাতের পাড়ের উপর একটি ইটের তৈরি ঘাট রয়েছে। প্রত্নস্থানটির পূর্ব ও দক্ষিণ দিক ঘিরে একটি রাস্তার চিহ্ন এখনো বিদ্যমান। এছাড়া রাস্তাটি প্রত্নস্থানের বিভিন্ন স্থানেও খননকালীন সময়ে উম্মোচিত হয়েছে।

 

প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, খানজাহান (রঃ) সময়কালে ধর্মীয় স্থাপনা হিসেবে মসজিদ এবং আবাসিক বা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য সেক্যুলার স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল। আধুনিক নগর পরিকল্পনার স্বীকৃত পদ্ধতি স্থান সমূহের বিভাজন সম্পর্কে খানজাহান (রঃ) এর পরিচ্ছন্ন ধারনার আভাস মেলে। সুপরিকল্পিত নগর হিসেবে ‘শহর খলিফাতাবাদ’ ক্রমশ: নগরায়ন প্রক্রিয়ায় পরিকল্পিত বাসোপযোগী অঞ্চলে পরিণত হতে থাকে। যার অনেক প্রামাণ্য উপাদান,তথ্য-উপাত্ত চলতি অর্থ বছরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। খননে উন্মোচিত বিভিন্ন ইমারতের দেয়াল, দেয়ালের দুই পাশে স্থান বিভাজনের মাধ্যমে কতগুলো দেয়াল ঘেরা বিভিন্ন সেগমেন্টের মধ্যে বসতি তৈরির নমুনা পাওয়া গিয়েছে। এসব নমুনা থেকে একটি সুপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা বা রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স হিসেবে গড়ে ওঠার প্রমাণ মেলে। পাশাপাশি সময়ের পরিক্রমায় প্রয়োজন ও চাহিদার মধ্য দিয়ে বসতি পরিকল্পনায় ক্রমশ: পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সম্প্রসারণ ও পুন:নির্মাণ প্রক্রিয়ায় দেয়াল ও মেঝেসমূহ ব্যবহারের  সুস্পষ্ট আলামত পাওয়া যায়। খননে উন্মোচিত নগর পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে ইট নির্মিত পাকা রাস্তা খানজাহান (র:) বসতভিটা ঢিবিতে পাওয়া গিয়েেেছ। খননে প্রাপ্ত রাস্তার অনুরূপ ও সমসাময়িক কালের প্রায় ১ কি.মি দৈর্ঘ্যরে একটি রাস্তা খানজাহান (র:) বসতভিটা হতে পূর্বদিকে গিয়ে শেষ হয়েছে। এই রাস্তাটি  ঐতিহাসিক খানজাহানের রাস্তা বলে খ্যাত।

 

প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সুলতানি যুগে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের সৌখিন ও নিত্য ব্যবহার্য্য মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে।  এর মধ্যে সুলতানি যুগের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বিভিন্ন আকৃতি ও পরিমাপের থালা, নলযুক্ত মৃৎপাত্র, পানি ছিটাবার পাত্রের (sprinkler), তৈল প্রদীপ, সাদা ওয়াশ (Wash) যুক্ত মৃৎপাত্র, চুন (calcareous) দিয়ে তৈরি ষ্টোন ওয়্যার, পলিক্রম ওয়্যার (polychrome ware), গ্লেইজড ওয়্যার (glazed ware), স্লিপ যুক্ত ওয়্যার (slipped ware), সেলাডন, চাইনিজ পোরসেলিন, এগ-শেল ওয়্যার প্রভৃতি মৃৎপাত্র উল্লেখযোগ্য। এধরণের মৃৎপাত্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত সুলতানি যুগের রাজধানী গৌড় প্রত্নস্থানে পাওয়া গিয়েছে। খননের ফলে এবছরই প্রথম ইন-সিটু অবস্থায় একটি বড় আকারের স্টোরেজ জার পাওয়া গিয়েছে।

 

প্রাপ্ত মৃৎপাত্রসমূহের বিশ্লেষণে দেখা যায় স্থানীয় মৃৎপাত্রের পাশাপাশি মধ্য এশীয় ও চীন দেশীয় মৃৎপাত্রের প্রভাব বিদ্যমান। স্থানীয় মৃৎপাত্রের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের হাঁড়ি ও বোওল (bowl) পাওয়া যায়। পারসিয়ান প্রভাবের বিভিন্ন ধরনের নলযুক্ত মৃৎপাত্র পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের টেবিল ওয়্যার পাওয়া যায় যেগুলোর গলা সরু ও বিভিন্ন ধরনের নকশাযুক্ত। সুলতানি যুগের রয়্যাল ব্লু গ্লেজড ওয়্যার পাওয়া যায়। এগুলো পারসিয়ান প্রভাবিত স্থানীয়ভাবে তৈরি মৃৎপাত্র। চীন দেশীয় মৃৎপাত্রের মধ্যে রয়েছে সেলাডন ও চাইনিজ পোরসেলিনের তৈরি বিভিন্ন আকৃতির বাটি ও থালা।

ঐতিহাসিক গ্রন্থসুত্র অনুসারে খানজাহানের আগমন পশ্চিম এশিয়া হতে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের ব্যবহৃত মৃৎপাত্রে মধ্য এশিয়ার মৃৎপাত্রের প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু চাইনিজ পোরসেলিন ও সেলাডনের ব্যবহার কি করে হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো ধরনের তথ্য অন্য কোনো মাধ্যম হতে পাওয়া যায় না। তবে সমসাময়িক প্রত্নস্থানগুলোতে এধরনের মৃৎপাত্র পাওয়া যায়। এগুলো চীনের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্কের কারণে এসেছিল বলে ধারনা করা হয়। এবিষয়ে উপকুলীয় অঞ্চলের সাথে এধরনের কোনো যোগাযোগ ছিল কী-না তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।

 

মৃৎপাত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন আকারের ও রংয়ের রঙিন টালি পাওয়া যায়। এধরনের টালি সাধারণত মেঝে ও দেয়ালের গায়ে অলঙ্করণের জন্য ব্যবহার করা হতো। সুলতানি যুগে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনেন অলংকৃত রঙ্গিন টালি পাওয়া গিয়েছে। সাধারণত মেঝেতে এধরনে রঙ্গিন টালি ব্যবহ্নত হয়। প্রাপ্ত টালিসমূহ ষড়ভূজাকৃতি , চতুষ্কোনাকৃতি, ত্রিকোনাকৃতির। এছাড়া ফুলের নকশাকৃত ও প্যাচানো লতা-পাতার নকশাকৃত অলংকৃত ইট পাওয়া গিয়েছে। এধরনের রঙ্গিন টালি ও অলংকৃত ইট  সুলতানি যুগের রাজধানী গৌড় সহ বিভিন্ন প্রত্নস্থানে পাওয়া গিয়েছে। গৌড় ও পা-ুয়ায় এধরনের রঙিন টালি ব্যবহার করে মেঝে নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

 

প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক আলামতসমূহের আলোকে খানজাহান (র:) বসতভিটা মধ্যযুগের ঐতিহাসিক নগর‘ শহর খলিফাতাবাদ’ এর অংশ বিশেষ হতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়।


'‌প্রত্নসম্পদ একটি দেশের অতীত ঐতিহ্যের বাহক' '‌প্রত্নসম্পদ জাতীয় সম্পদরক্ষার দায়িত্ব সকলের' 'পুরাকীর্তি আইন সম্পর্কে সচেতন হোন'